বোশেখ মাসের কোন রাতে যদি ঘুম ভেঙে দেখেন অদ্ভুত শীতল রাত্রি, নিশ্চিত রুমের বাইরে এখন দুই পা গেলে টানা লম্বা করিডোর। যার শেষ প্রান্তে ঝুল বারান্দা। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত জ্যাসমিন। আলাদিন কখন উড়ন্ত গালিচায় করে আসবে।
বিছানা ছেড়ে উঠলাম। সন্তপর্নে এসে চেয়ারে বসেছি যেন শব্দের ঘুম না ভাঙে। জানালার বাইরে আমড়া গাছের মাথা জুড়ে ঝাকড়া পাতা। চাঁদকে আড়াল করে রেখেছে তারা। চাঁদের গা বেয়ে নেমে আসে যে আলো, পাতার ফাক ফোকর দিয়ে পরছে এসে টেবিলে। আমি তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করলাম আলোক রশ্মি।
আমার ঘুম ভাঙল কেন? ভয়ংকর কোন স্বপ্ন দেখিনি, যা দেখতাম পরীক্ষার সময়। খেয়াল করলাম নাক আটকে গেছে, স্বর্দি হয়েছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে তাই। প্রকৃতি ঘুমিয়ে আছে তার সহজাত স্নিগ্ধতা নিয়ে। তাকে জাগিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কি করা যায় বল তো? হাসি মুখে নির্ঘাত বলবে,
' চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পার,
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো ।'
এই শহরে কোন পেপে গাছ নেই। বাড়ির উঠানে একটা পেপে গাছ দেখে ছিলাম ছোটবেলায়। তা কবে যেন কেটে ফেলা হয়েছে ভুত থাকে বলে। মনে করতে পারছি না। উহ! কি অস্বস্তি লাগছে। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস করতে পারছি না। তাই ঠোট দুটো ঈষৎ ফাকা করে শ্বাস প্রশ্বাস করছি।
দুপাশে খোলা জানালাওয়ালা একটা রুমে বসে আমার বোন ছবি আঁকত। সেসব ছবির উপাদান খুব সীমিত। নৌকা, নদী, গাছপালা, ঘর, আকাশ, পাখি, একজন অলস মাঝি যে বৈঠা হাতে বসে আছে।
সেবার জন্মদিনে সে আমাকে একটা ছবি এঁকে গিফট করেছিল। সাধারণ সব উপদানগুলোই উপস্থিত ছিল। আমার খুব করে মনে আছে ঘরটার উঠানে একটা পেপে গাছ আঁকা হয়েছিল। গাড় সবুজ পাতা আর তিনটে পেপে ঝুলছে তার গায়ে। আজ রাতে সেখানে যাওয়া খুব দরকার।
নিঝুম রাস্তায় নেমে এলাম। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে জ্যাসমিন দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। আজ রাতের গায়ে তাই গাড় নীলাভ রঙ লাগা। পথে হাটছি। চাঁদ যাচ্ছে আমার সাথে। বৈশাখ মাসের এক অদ্ভুত শীতল রাত্রি।
একটা ফিটন গাড়ি নিয়ে সহিস অপেক্ষা করছিল। চার রাস্তার মোড়ে। দরজা খুলে ঢুকলাম। আরও তিনজন বসে আছে। সবাই একই রকম দেখতে। লম্বাটে ছায়াদের কথা বলছি। ফিটন ছুটছে ঝড়েরবেগে। গ্রাম শহর জঙ্গল শেষে এসে থামে নদীর তীরে। একটা বজরা দাড়িয়ে আছে তীরে।
বজরার ছাদে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম।মাঝিরা একই সাথে দার বেয়ে চলল। নিচ তলা থেকে তারা গেয়ে চলেছে একটা গান। যা শুনতে অবশ্যই গানের মত না। মনে হবে প্রাচীন কোন বৃহদাকার ঘুমন্ত দানব নাক ডেকে যাচ্ছে।
এসে থামল ঘাটে। আমি নামলাম। এটা ধূসর শহর। আমার বোনের আঁকা ছবিটা না। লম্বা ছায়রা এখানে খুব ব্যস্ত। উদ্ভট তিন চাকা, চার চাকা যান নিয়ে তারা ঘোরা ফেরা করছে রাস্তায় । তারা ফিসফিস করে অনবরত চেচিয়ে যাচ্ছে। আসুন আমরা আপনার গন্তব্যে পৌছে দেব।
এরা পারবে না আমরা জানি। পিছনে ফিরে দেখি বজরাটা নেই। মুখ দিয়ে কিছু বাতাস নিলাম বুকে। সাথে এলো কিছু বিষণ্নতা। ধূসর শহরের বাতাসে বিষণ্নতা।
তিনচাকার যানে উঠেছিলাম। ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হয় তা চলার সময়। লম্বা ছায়াটা আমায়ও তাই বলেছিল অন্যদের যা বলে। অথচ নামিয়ে দিল একটা রাস্তার পাশে। যেখানে আকাশের গায়ে মিশে আছে সন্ধ্যাবেলা। এক জীর্ণ বস্ত্র পরিহিত মহিলা বসে আছে রাস্তার ধারে। তাকে ঘিরে কিছু শিশু। মহিলাটি খেয়ে চলেছে হাতের পলি থেকে পান্তা ভাত আর পেয়াজ। শিশু গুলো চেয়ে রয়েছে তার দিকে। তারা জানে একসময় তাদের দিকে উনি ছুড়ে দিবে এক মুঠো ভাত। এমন অপেক্ষা করতে হয় অনন্তকাল ধরে। যার অপেক্ষার ভারে শরীর ক্ষয়ে কঙ্কাল হয়ে যায়, একঝাঁক দাড় কাক এসে সেই কঙ্কাল গুলো নিয়ে যায়। কঙ্কালের স্তুপ হয়েছে একটু দূরে।
এখানে আশেপাশে কোথাও পেপে গাছ নেই। আবার উঠে পরলাম ক্রিং ক্রিং তিনচাকার যানে। সে এবার নামিয়ে দিল ওয়েটিং স্টান্ডে। সাড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা ছায়ারা। আমি সবার শেষে।কে যেন ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি দেড়ি করে ফেলেছ।
দেখলমা সবাই একএক করে ওই টিনের বাক্সে উঠছে।
একটু পরই বলা হল আর একজন উঠতে পারবে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন। সে উঠে গেলে আমাকে নেয়া হবেনা। চকিতে তারে ধাক্কা দিয়ে উঠে গেলাম। যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে বাক্সটা চলতে শুরু করল। জানালা দিয়ে দেখলাম অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে ছায়াটা।
টিনের বক্স ছুটছে। মেঘের শহর পার হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে আরও।
ওই যে মেঘের শহর। ওখানে এখন কোন মানুষ নেই।শুধু প্রানীদের বিচরণ। তাদের জীবন আবর্তিত হয় মদ, নারী আর অশ্লীল গানে। একদিন সকালে উঠে তারা দেখতে পায় সবাই শুকুর এবং বানরে পরিণত হয়েছে। অথচ লম্বা ছায়ারা মেঘের শহরে আসবে বলে লাল সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
টিনের বক্স এখন ছুটছে অন্তরীক্ষে। অনন্তকালের যাত্রা। সিটে বসে চোখ বুজলাম। আমার একটা পেপে গাছ খুজে পেতে হবে। হঠাৎ মনে হল আমার প্রকৃতিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তাকে ছাড়া বাচার এত আয়োজন বৃথা।
অথচ এখানে অনন্তকালের যাত্রা। টিনের বক্স কখনো থামে না। পাশ দিয়ে ছুটে চলে ধুমকেতু, গ্রহ, নক্ষত্র, বিভিন্ন মাত্রার প্রানী আর জগত। ফেরার পথ কি নেই?মনে পরল প্রকৃতি শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়।
চোখ বুজে কিছু না ভেবেই লাফ দিলাম মহাশুন্যে। প্রকৃতিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার চোখের কাছে এসে জমা হচ্ছে জল। দিকশূন্যপুর আমায় মুক্তি দাও।