কর্কশ শব্দ মাথায় করে ধুলোজমা শরীরটা নিয়ে কেবল মেসে ঢুকলাম, এসেই দেখি লোডশেডিং। কোনো মানে হয়? ভেবেছিলাম খানিক জিরিয়ে নিয়ে তিনদিনের ক্ষরাজমা শরীরটাকে একটু ভিজিয়ে নেবো। মা যদি জানেন তিনদিন গোসল করি না,নিজে এসে কান ধরে ঢুকাবেন গোসলখানায়। শেষ কবে কথা হয়েছিল মায়ের সাথে মনে পরে না। তবে এখনো একটু চোখ বুজলে শুনতে পাই ভাতঘুমে নিশপিশ করা দেহখানি বিছানায় এলিয়ে দেয়ার মুহুর্তে শিথানে বেজে ওঠা সুমন কিংবা প্রিসলির কন্ঠ। তড়িঘড়ি ঘর্মাক্ত শার্টটা বারান্দা লাগোয়া খাটে ফেলে রেখে ঢুকে পড়লাম গোসলখানায়। খাটটা বারান্দার পাশে হওয়াতে বেশ সুবিধাই হয়েছে। মাকে যখন গভীর রাতে ছুঁতে চাইতাম, যখন নিজেকে মায়ের গাঁয়ে লেপ্টে ধরে শৈশবের ঘুমপাড়ানি গান মনে করতে চাইতাম; কী সুন্দর আবেশে দিশাহারা পথিক মাঝ আকাশে ছোটাছুটি করতো। বারান্দার রেলিংয়ে এসবের কিছুই আটকাতো না যেনো সেন্টমার্টিনের নীল সাগর, কী স্পষ্ট তার নিচে তলিয়ে যাওয়া পাথর।
গুমগুম আওয়াজ আরো এগিয়ে আসছে মনে হয়। এসময়ে তিন কামড়ার এ ফ্লাটে কারো আসার কথা নয়।
সাম্যর গলা? দাঁড়কাকের মতো শুকনো সাম্যর গলায় এতো জোড় আগে কখনো টের পাইনি কেনো? কী বলতে চায় ও? দেখিনি কেমন চুপচাপ গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মার খেতে দেখেছে। তখন ওর গলা থেকে সুরেলা মিনমিন আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কী বের হয়েছিলো?
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি গার্মেন্টসের কল্লোল মিয়ার মতো শুষে যাওয়া মুখের অবয়ব ফুটে উঠেছে সাম্যের চেহারায়। ওদের চেহারার এতো মিল আগে কখনো চোখে পড়ে নি।
কেমন এক লহমায় বলে ফেললো কথাগুলো,"তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলো ভাইয়া,আমি তোমাকে নিয়ে যাবো"।
প্রায় টেনে নিয়ে খাটে পরে থাকা শার্টটা পরালো। ততক্ষণে ঘাম শুকিয়ে গেছে বোধহয়,আগের মতো আর ভেজা লাগছে না। রাত কেবল গাঢ় হচ্ছে। অন্ধকারে পুঁথিমালা বোনার মতো করে চলে বুঝি ইঞ্জিনগাড়িটা। শেষ মুহূর্তে দৌড়ে গিয়ে ধরতে হয়েছে বলে হাঁপানিটা একটু বেড়েছে। গাড়িটা আধেক সাদা আধেক নীল রঙে ছেয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন গাড়ি নয় মাঝরাতে হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয়া হকারদের পুষ্পালয়। কঠোর দৃষ্টিপাতে এদের প্রত্যেকের চেহারায় ভাসে অতি নিদারুণ স্বরে বলতে চাওয়া গান।
জানালামুখো পর্দাগুলো সরিয়ে দিতে শান্ত শীতল আদো হাওয়া লাগে গাঁ জুড়ে। চোখের জ্বালা ভাবটা কমে গিয়ে এখন প্রায় নিভু নিভু। সাম্যকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। বহুদিন এমন শান্তির ঘুম ঘুমাই নি।
ভেজা ঘাসে পা পরে, পুরো শরীরে টের পাই বিষণ্ন বিয়োগ ব্যথা।চোখ মেলে দেখি বাড়ি ভর্তি লোক। পুব পাশের পুকুরে কৃত্রিম আলো জ্বালা। ভোরের আদো কালো আদো ঝাপসা আলো তখনো প্রকট হয় নি। টাইলস বাঁধানো পুকুর ঘাটে কাকে দেখা যায়? সমন্বিতা? ইশ! এবারো ভুলে গেছি। প্রতিবার বাড়ির চৌকাঠে পা পরা মাত্রই কেমন সহাস্যে বলে ওঠে,"ভাইয়া পাঁচটা চকলেট"। নতুন গজানো বুনো কলমির মতো সতেজ হাসি যার মুখে তাকে ওমন ঝড়ে পরা টকটকে লাল জবার মতো লাগে কেনো? আদো ঘুম তখনো লেগে আছে চোখে। দ্রুত বেগে ছুঁ মেরে কে যেনো পুকুরের পাড় লাগোয়া মাঠে নিয়ে নামায়। মানুষে কেমন গমগম করছে মাঠটা। নতুন গজানো দুর্বা ঘাসগুলো আদোও টিকবে তো?
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে মানুষগুলো জলে ভাসা পিপড়ার ন্যায় পাড় খোঁজে,একে ওকে ধরে একটু বেঁচে যাওয়া। ছʼজন মানুষ তখনো দেখি মাঠের মাঝে পরে থাকা এক টুকরো শিউলি ফুল মাথায় করে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে ছেয়ে গেছে পুরো মাঠ। শিউলির গন্ধ যুদ্ধে সৈনিকের বুক ফেটে বেরিয়ে আসা তীরের মতো ধেয়ে আসে। টপটপ করে পরা পানিতে ভিজে গেছে তার পাপড়ি। বুক ফেটে বেরিয়ে আসা রক্তরাঙা বোটা মাথায় ধবধবে সাদা পাপড়ি, শিউলি ফুল। ওমন ছোট্ট একটা ফুলের এতো তেজ?
আধেক পানিজমা কবরে ভাসিয়ে দেয় শিউলিটিকে এরপর মাটিচাপা যদি একটু তেজ কমে। ক্ষপ করে হাতটা ধরে প্রায় কাদো কাদো কন্ঠে কে যেন বলে,"বড়ো ভালো ছিলেন তোমার মা,কী স্বাদের এক গ্লাস লেবুর শরবত যে তিনি খাওয়াইলেন। জ্যান্ত মানুষটা এহনো চক্ষে ভাসে। কষ্ট নিয়ো না; আল্লার জিনিস আল্লায় নিয়া গেছে। সবই তেনার মর্জি"। শরীর থেকে চুইয়ে পরে বৃষ্টির পানি,আমি ভাবছি মা কোথায় গেলেন আমি যে টানা তিনদিন গোসল করি না সে খবর কী মা জানেন?