সাদা-কালো চোখে, শান্ত স্মিত মুখের কোন বুড়োর দৃষ্টি দিয়ে দেখি। স্কুল ক্যাম্পস্টা তখন এমন পাকা ছিল না। বর্ষার সময় জল জমে যেত। তাতে থ্রি- ফোরের বাচ্চাদের ভাসানো দু- একটা কাগজের নৌকো। স্নানসিক্ত রেইনট্রি, মেহগনি, ঝাউয়ের সারি আরও সবুজ হয়ে উঠত। সেসব দিনে বর্ষা মাথায়, ক্যাম্পাসে জমা পানিতে পা ডুবিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
প্রচন্ড বৃষ্টিতে করিডোরে বসে ক্রিকেট খেলার সেই অদ্ভুত সুন্দর দিনগুলো। ব্যাট বলতে সেই যে একটুকরো কাঠের তক্তা। একদিন টিফিনে বৃষ্টির পানি মাথায় নিয়েই বুড়ো চাচার সিঙারা খেয়েছিলাম। বর্ষার সবচেয়ে বড় আনন্দ বোধ হয় বড় মাঠের কাদা মেখে ফুটবল খেলায়।
স্কুলের বর্ষার স্মৃতিগুলো নিয়েই এক দিস্তে লিখে ফেলা যায়। তবে কি বর্ষা মাথায় নিয়ে স্কুলে পা দেইনি। জানুয়ারীর কনকনে শীতের সময় এক মিষ্টি ভোরে স্কুলে পা রেখেছিলাম। ছোট্ট বুকে তখন জুবিলীয়ান হতে পারার এক বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দ। রাজ্য জয় করলে বুঝিবা অমন আনন্দ হয়।
অ্যাসেম্বিলি ফাকি দিয়ে ক্লাসে লুকিয়ে থাকা কিংবা অ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়িয়ে করা দুষ্টুমি। টিফিন টাইমে খাবারের ভ্যানেগুলোর সামনের ভিড়। টিফিন ভাগ করে খাওয়া তারপর ক্লাসে বসে কাবাডি খেলা। গরমের দিনগুলোতে ক্লাসে কেমন বিরক্তি এসে যেত।বেঞ্চগুলো তখন হয়ে উঠত রীতিমতো বাদ্য আর সবার কন্ঠে গান। ভিনদেশী তারা, কার পোষা পাখি, লোকে বলে, তোমার ঘরে বসত করে আরও কতশত সুর! স্পোর্স্টের সময় এক ভিন্ন আনন্দ হত আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সন্ধ্যার সেই আমেজ!
এই স্কুলে শিক্ষকদের কেউ হয়তো বন্ধুসুলভ আবার কেউ কেউ জানেন পিতৃস্নেহে আগলে রাখতে।কারো কারো শিক্ষা দানের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছি। কাউকে খুঁজে পেয়েছি শিক্ষক থেকে বেশি খাটি মানুষ হিসেবে। বয়সের দোষেই হয়তোবা কোন কোন জনকে ঠিক তেমন শ্রদ্ধা করতে পারিনি।
স্কুল ক্যাম্পাসে, হোস্টেলের সামনে, গাছের নিচে, পুকুরপাড়ে জুবিলীয়ানদের হাসি, আড্ডা, গান হাজার বছর বেচে থাকুক।
আর সবার মতই স্রোতের টানে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। সবাই কতগুলো বছর এক সাথে ভাসলাম। একে অপরকে হাসালাম, কাদালাম, গাল পারলাম, মারামারি করলাম। আবার এখন স্রোতের টানে কে জানে কই ভেসে যাই সবাই। ভাবলে সব স্মৃতি আজ বায়োস্কোপের মত সামনে এসে যায়।
গাছের শাখায় আমরা জন্মেছিলাম একদল সবুজ পাতা হয়ে। ক্রমে ক্রমে এখন পাতার রঙ হলুদ। ঠিক ঝড়ে পরার নয়, শাখা ছেড়ে নিরুদ্দেশে উড়ে যাবার সময় হয়ে এলো। উড়তে উড়তে সেসব পাতা বদলে আরও কত বর্ণের হবে। সারা পৃথিবী ঘুরে সাবাই হয়তো এসে একদিন জড়ো হবে স্কুলের সবুজ ঘাসের উপর।
দীপান্তরে চলে গেলেও, স্কুলের লাল ইটগুলোর গায়ে, গাছগুলোর কাছে, সবুজ ঘাসের মাঝে, ক্লাসের দেয়ালে, পুকুরপাড়ে, চারদিকের বাতাসে লিখে রেখে গেলাম আমাদের গল্প।আরও কত শত গল্পের সাথে সেগুলো মিশে থাক।
বিদায় দিনটা কাটল সেদিন
উম্মাদনার সুরে।
ঘোর লাগা দিন, ঘোর লাগা রাত
হালকা মেঘের আড়ালে ছিল
এক খন্ড চাঁদ।